অনুবাদ- উপহার

উপহার
-সাদাত হাসান মান্টো
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন

 

 

দিল্লিতে থিতু হয়ে বসার আগে সুলতানার রাজ্যপাট ছিল আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে তার বাঁধা বাবুদের মধ্যে জনা কয় গোরাও ছিল। তাদের কাছ থেকে গোটাকয় ইংরেজি লব্জও শিখেছিল সে। এমনিতে ইংরেজি শব্দ সে বিশেষ বলেনা। কিন্তু বিপাকে পড়লে আপনা থেকেই তার ইংরেজি বুলি বেরিয়ে আসে। নতুন শহরে সে এসে দেখে বাজারের হাল খুব খারাপ। আর তার যে ব্যবসা সেটার তো কোনও দরই নেই। একদিন ব্যাজার মুখে পাশের কোঠার তামাঞ্চা জান-কে সে এসে বলে… ‘বুঝলে…দিস লেইফ ভেরি ব্যাড’। হাতে কোন কাজ নেই…পরের বেলার খাবার কোত্থেকে জুটবে তার কোনও ঠিক নেই…এমন অবস্থায় পড়লের মুখ থেকে তো এমন দার্শনিক বুলিই বেরোবে!
আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে জীবনটা ছিল একদম ফুরফুরে। ব্যবসার এত রমরমা ছিল যে একা হাতে সে সামলে উঠতে পারত না। গোরা, ব্রিটিশ টমিরা সব গলা অবধি গিলে সন্ধে বেলা ভিড় জমাত তার কোঠায়। তার সুলতানাও তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ করে তাদের পকেট ফাঁকা করে দিতবিদেয় করে । দেশি বাবুরা মাঝে মাঝে তার কাছে আসত ঠিকই কিন্তু গোরাগুলোকেই সুলতানার বেশি পছন্দ ছিল। গোরাগুলোর ভাষা সে বুঝত না বটে কিন্তু এটা তার কাছে শাপে বরই হয়েছিল। কেউ যদি কোঠায় এসে বেশি দরদাম করত তাহলে সে এমন ভান করত যেন সে কিছুই বুঝছে না। মাথা ঝাঁকিয়ে সে তার নিজের ভাষাতেই বলে যেত… ‘আপনে ক্যা কাঁহা মালিক…ঠিক সে সমঝা নেহি’। আবার তারা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করত তাহলে সুলতানাও গালাগাল দিয়ে তাদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিত। সুলতানার ভাষা বুঝতে না পেরে তারা বুরবকের মতো চেয়ে থাকত…খানিকটা হতভম্বও হয়ে পড়ত। কিন্তু সুলতানাকে থামায় কে?… ‘সাহাব তু তো একদম কামিনা নিকলা…উল্লুকে পাঠঠে…হারামজাদা কঁহিকা’। মজার কথা ভেবে গোরাগুলো হে হে করে হেসে গড়িয়ে পড়ত আর মুচকি হাসত সুলতানা।
কিন্তু দিল্লিতে আসার পর তিন মাস হয়ে গেল। এখনও একজনও গোরা এলনা তার কাছে। আম্বালায় থাকতে থাকতে এই বড় শহরের কথা সে কত শুনেছে। এখানে নাকি টাকা উড়ে বেড়ায়…শুধু খপ করে ধরে নিতে পারলেই হল। এখন তো দেখা যাচ্ছে সব বকোয়াস। এখানকার সব বড় বড় লাটসাহেবরা কোথায় গেল? সুলতানা শুনেছে তেনারা নাকি সব সিমলায় পাড়ি দিয়েছেন। ওখানেই গরমকালটা কাটিয়ে আসবেন। এই তিনমাসে ছজন খদ্দের। এই তার ব্যবসাপাতির হাল। হ্যাঁ মাত্র ছজন! এই ছজনের মুখেও আবার সেই বাঁধা বুলি…দিল্লির রইস আদমিরা নাকি এখন সব সিমলার পাহাড়ে। এই তিনমাসে ছজন খদ্দেরের কাছ থেকে সুলতানার রোজগার হয়েছে মাত্র আঠেরো টাকা আট আনা। সবকটা আবার হাড় কঞ্জুস। তিনটাকার বেশি এক পয়সা কেউ বের করবে না। এখানে তিনটাকার বেশি কেউ দেয়ও না। প্রথম পাঁচ জনের কাছ থেকে সুলতানা দশ টাকা চেয়েছিল। সেটা দরাদরি করে নেমেছিল তিনে।
কেন যে বেছে বেছে ওরা তার কাছেই এসেছিল তা সুলতানা বলতে পারবে না, তবে ছ নম্বর লোকটা যখন এল তখন সুলতানা গম্ভীর মুখে আগেভাগেই শুনিয়ে দেয়… ‘আমি তিন টাকা নিই। এর এক পয়সা কম নয়। পোষালে আসুন নাহলে কেটে পড়ুন’। লোকটা কী ভাবল কে জানে তবে সে সুলতানার ঘরে গিয়েই ঢুকল। লোকটা যখন জ্যাকেটটা খুলছে তখন আদুরে গলায় সুলতানা বলে… ‘আর একটা টাকা বেশি দিতে হবে’। এক টাকার বদলে সুলতানা পেল আট আনার চকচকে একটা কয়েন…তার ওপর আবার রাজার মুখ খোদাই করা। সুলতানা আর কী করে! নাই মামার চেয়ে কানা মামাও তো ভালো।
এই শহরে এসে হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে সুলতানার। তিন মাসে মাত্র আঠেরো টাকা আট আনা। আর ওদিকে খরচের তো মা-বাপ নেই। কোঠার ভাড়া মাসে কুড়ি টাকা। কোঠা তো নয়…পিঁজরাপোল একটা! বাড়িওয়ালা আবার একেই কেতা দেখিয়ে বলে ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাটে আবার ওয়েস্টার্ন টয়লেট। তাতে আবার চেন লাগানো। এমন জিনিস তো বাপের জম্মে দেখেনি সুলতানা…ব্যবহার করা তো দূর অস্ত। সে ভেবেছে ঐ চেন ধরে বুঝি উঠতে হয়। সেদিন কোমরটা খুব টনটন করছিল। উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট। তা সুলতানা ঐ চেন ধরে উঠে দাঁড়াতে গেছে অমনি গোটা বাথরুম জুড়ে একেবারে জলপ্রপাত। ভয় পেয়ে চেঁচয়ে ওঠে সে।
পাশের ঘরেই নিজের ফোটোগ্রাফির জিনিসপত্রগুলো একটু গোছগাছ করছিল খুদা বক্স। সুলতানার চিৎকারে সে তো পড়ি কি মরি করে ছুটে আসে… ‘সুলতানা তুই?’
ভয়ে তখনও বুক কাঁপছিল সুলতানার… ‘এটা কি বাথরুম নাকি রেল স্টেশন? মনে হচ্ছিল প্রাণটা বুঝি বেরিয়েই যাবে’।
খুদা বক্স তো হেসেই খুন… ‘বোকা মেয়ে…এটা হচ্ছে বড় শহরের বিলাইতি বাথরুম। বুঝলি?’
বিধাতা যে কী ভাবে এই দুজনকে মিলিয়ে দিলেন! খুদাবক্স রাওয়ালপিন্ডির ছেলে। হাইস্কুল পাশ করার পর একটা সে বনে যায় লরি ড্রাইভার। পরে কাজ নেয় একটা বাস কোম্পানিতে। রাওয়ালপিন্ডি আর কাশ্মীরের মধ্যে সেই কোম্পানির বাস চলত। কাশ্মীরে এক মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। সে তার সঙ্গে পালিয়ে আসে লাহোর। সেখানে হাতে কোনও কাজ নেই। দুর্দশার একশেষ। যে মেয়ে একদিন তার হাত ধরে পালিয়ে এসেছিল পেটের দায়ে সেই মেয়েকেই পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসায় নামিয়ে দেয় খুদা বক্স। এমনি করেই বছর দুয়েক কেটে গেল। তারপর সে চিড়িয়া অন্য আরেকজনের সঙ্গে ফুড়ুৎ। কেউ কেউ বলে তাকে নাকি আম্বালায় দেখা গেছে। সে ছোকরিকেই খুঁজতে খুদা বক্সের আম্বালায় আসা। এখানে এসে সে ছোকরি তো মিলল না কিন্তু মিলে গেল সুলতানা। প্রথম দেখাতেই খুদা বক্সকে মনে ধরে যায় সুলতানার।
খুদা বক্স আসার পরই সুলতানার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করে। ব্যবসাপাতি বেশ ভালোই জমে ওঠে। সুলতানার মনে অনেক সংস্কার। সে ভাবে এত রোজগারপাতি সবই বুঝি খুদা বক্সের জন্য।
ওদিকে খুদা বক্স নিজেও খুব পরিশ্রমী। এক মুহূর্তও চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। ওখানে রেলস্টেশনের ধারে একজন ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় খুদা বক্সের। কিছুদিনের মধ্যে ভাবও জমিয়ে ফেলে। সে চালাক-চতুর মানুষ। সেই ফটোগ্রাফারের কাছ থকে কিছু দিনের মধ্যেই ছবি তোলার কায়দা-কানুন শিখে ফেলেসে। নিজের ব্যবসা শুরু করার জন্য সুলতানা তাকে ষাট টাকা দেয়। সেই টাকায় একটা পুরোনো ক্যামেরা, একটা পর্দা, গোটাকয় চেয়ার আর কিছু প্রয়োজনীয় রাসায়নিক কিনে ব্যবসা ফেঁদে বসে খুদা বক্স। একদিন সে সুলতানাকে এসে বলে এবার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেতে হবে…সেখানে নাকি ব্যবসার অবস্থা অনেক ভালো। সেখানে এসে ভালো বাসাও মিলে গেল। খুদা বক্সের কাছে যে গোরারা ছবি তোলাতে আসত তাদের অনেকেই সুলতানার কোঠাতেও যাতায়াত শুরু করল।
বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেলল সুলতানা। সে টাকা দিয়ে এক জোড়া রুপোর কানের দুল আর আটটা বালাও কিনে ফেলল। তার তোরঙ্গে এখন পনেরোখানা দামি শাড়ি। ঘর সাজানোর জন্য কয়েকটা আসবাবও কেনা হল। সবকিছু ভালোমতোই চলছিল। হঠাৎ একদিন উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ের মতো খুদা বক্স এসে বলে এবার তাদের দিল্লিতে যেতে হবে। সুলতানা তো এককথায় রাজি। খুদা বক্সের জন্যই আজ তার কপাল ফিরেছে।
নতুন শহরে একটা ব্যবসা জমে উঠতে যে কিছুদিন সময় লাগবে সেটা সুলতানা আগে থেকেই জানত। প্রথম মাসে কোনও খদ্দের জোটেনি। তা যাকগে…তাতে অত চিন্তার কিছু নেই। দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে এবার সত্যিই তার কপালে ভাঁজ পড়ে। এতদিনে একজনও এই কোঠার পা মাড়াল না। একদিন সে খুদাবক্সকে বলেই ফেলে… ‘ কী হচ্ছে বলতো? দুমাস হয়ে গেল এখনও এই চত্বরে কারো দেখা নেই! জানি এখন বাজারের অবস্থা খারাপ, তাবলে এতটা খারাপ?’
খুদা বক্স মুখফুটে সুলতানাকে কিছু বলেনা বটে কিন্তু তারও চিন্তা হয়… ‘আমিও ভেবেছি। কিন্তু বুঝলি সবকিছু এই কমবয়াক্ত যুদ্ধের জন্য। এই যুদ্ধের জন্যই এসব পাড়ায় আর লোকজন আসছে না…আবার এমনটাও হতে পারে যে…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় টোকা। লাফিয়ে উঠে দরজাটা খুলে দেয় খুদা বক্স। নতুন শহরে সুলতানার প্রথম খদ্দের। আয় হল তিন টাকা। অন্য পাঁচজনেরও কাছেও ঐ একই দাম মেলে।
কপালে এবার সত্যিই ভোগান্তি আছে। কোঠার ভাড়াই তো মাসে কুড়ি টাকা। তারওপর জল আর ইলেক্ট্রিসিটির বিল আছে। খাইখরচা আছে। তারপর জামাকাপড়…এটা সেটার খরচ তো লেগেই আছে। এই আঠেরো টাকা আর আট আনায় কীইবা হয়? আম্বালায় থাকতে সে আটটা সোনার বালা সুলতানা গড়িয়েছিল একে একে সব গেল। শেষ বালাটা বিক্রি করার সময় সে খুদাবক্সকে বলেই ফেলে… ‘চলো আমরা আম্বালাতেই ফিরে যাই। এই শহরে আমরা আর করে-কম্মে খেতে পারব না। এই শহর আমাদের কিচ্ছু দেবে না। আমাদের যা গেছে তা গেছে…ভাবব কোন গরিব মানুষকে দান করে দিয়েছি। যাও এই চুড়িটা বিক্রি করে এসো। আমি ততক্ষণে মালপত্রগুলো গুছিয়ে নিই। আজ রাতের ট্রেনেই আমরা আম্বালা ফিরে যাব’।
খুদাবক্স চুড়িটা নিয়ে নিল বটে কিন্তু এ শহর ছেড়ে তার যাওয়ার মন নেই… ‘ না, সোনা আমরা আম্বালা যাব ন। এই শহরেই থাকব। এখানেই অনেক পয়সা কামাবো। তোর সোনার চুড়ি আবার হবে। শুধু আল্লার ওপর ভরসা রাখ। তিনিই আমাদের পথ দেখাবেন’। সুলতানা আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু নিরাভরণ হাত দুটো দেখে তার কান্না পেয়ে যায়।
দুমাস কেটে যায়। যা আয় হয়েছে তা দিয়ে সিকিভাগও খরচ ওঠে না। সুলতানা জানে না এবার সে কী করবে। খুদাবক্স তো সারাদিনই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। তাই আরো নিঃসঙ্গ লাগে সুলতানার। প্রথম প্রথম আশেপাশের কোঠাওয়ালিদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করে সময় কাটিয়ে দিত। কিন্তু এখন আর সেসব ভালোলাগে না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও তাই বন্ধ হয়ে গেল। এখন সারাদিন বাড়িতে বসে সে পান সাজে, সুপুরি কাটে…পুরোনো জামাকাপড়গুলোকে সেলাই করে। মাঝে মাঝে সে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে সে রেল-ইয়ার্ডটা রয়েছে সেদিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সারাদিন ধরে ইঞ্জিন খোলা, জোড়া হচ্ছে। মালপত্র নিয়ে সব ওয়াগন আসছে।
রেল-ইয়ার্ডের মাঝেই রেলের গুদাম। সেখানে একটা বিশাল টিনের ছাউনির নীচে হাজার, হাজার বাক্স, গাঁটরি পড়ে রয়েছে। গুদামের বাঁ দিকে খোলা জায়গা। সেখান দিয়ে সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলে গেছে রেল লাইন। রেললাইনগুলো এইদুপুর রোদে খোলা তরোয়ালের মতো ঝলসে উঠছে। তা দেখে নিজের হাতের দিকে নজর চলে যায় সুলতানার। তার হাতের নীল শিরাগুলোও চামড়া ভেদ করে যেন উঠে আসছে। পাশের ঐ রেলইয়ার্ড সারাক্ষণই কর্মমুখর। কিছু না কিছু চলছেই সেখানে। ইঞ্জিন আসছে। মালগাড়ি আসছে ধুঁকতে ধুঁকতে। মালপত্র খালাস হচ্ছে। আবার সে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে।
হুইসল দিয়ে ইঞ্জিন আসছে। তারপর ঝিক ঝিক করতে করতে চলে যাচ্ছে দৃষ্টিপথের বাইরে। সকালে সুলতানা যখন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় তখন প্রতিদিন একই দৃশ্য সে দেখে। ভোরের আলোআঁধারিতে সে দেখে একটা ইঞ্জিন ধোঁয়াউগরাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকালেও সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী। মাঝে মাঝে সে দেখে রেলের বগি থেকে ইঞ্জিন খোলা হচ্ছে। সেই ইঞ্জিনই আবার ঝিক ঝিক করতে করতে চল যাবে অন্য কোথাও। ইঞ্জিনটাকে দেখে নিজের কথাই মনে পড়ে সুলতানার। তাকেও কি জীবনের রেলপথে টেনে ফেলা হয়নি? ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না করে সেও তো চলছে ধুঁকতে ধুঁকতে। তার কলকবজাগুলো রয়েছে অন্যের হাতে। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে একদিন হয়তো ইঞ্জিনের সঙ্গে তার সব যোগ তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কোনও অজানা জায়গায় এসে হয়তো থেমে যাবে তার চলা। আর কখনো সে ঘুরে দাঁড়াবে না।
এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রেলপথের দিকে তাকিয়েই তার বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। চারদিকের নৈঃশব্দকে খান খান করে বেজে ওঠে কোনও ট্রেনের হুইসল। নানা চিন্তা ঘুরপাক খায় তার মাথায়। আম্বালাতেও তার বাসার কাছেই ছিল রেলস্টেশন। সে তখন কোনও ট্রেন দেখেনি…ইঞ্জিন দেখেনি। মাঝে মাঝে তার মনে হত এই রেলস্টেশনই বুঝি ঘিনঘিনেধোঁয়াটে বিশাল একটা বেশ্যাখানা। আর ট্রেনের পেটমোটা সব ইঞ্জিনগুলো বড়লোক, রইস সব খদ্দের যারা মাঝে মাঝে তাকে দর্শন দিয়ে যেত।
আবার কখনো কোনও ইঞ্জিন ওয়াগনগুলোকে টানতে টানতে ইয়ার্ডে নিয়ে আসত। সুলতানার মনে হত ওগুলো যেন সব নামি দামি খদ্দের। প্রতিটা জানালার ধারে তার মতো মেয়েমানুষদের দেখে জল মাপতে মাপতে এগোচ্ছে। এসব কথা ভাবলেই মনটা বড় চঞ্চল হয়ে ওঠে সুলতানার। তাই সে ব্যালকনিতে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়।
একবার নয়, দুবার নয় বারবার সে খুদাবক্সকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে… ‘আমার ওপর রেহম কর খুদাবক্স। এই ঘরে সারাদিন আমার কীভাবে কাটে তা কি ভেবে দেখেছ? সকাল থেকে রাত অবধি শয্যাশায়ী রুগির মতো ঘরবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিই’। কিন্তু প্রতিবার নানা অছিলায় কথাখানা এড়িয়ে যায় খুদাবক্স… ‘জানেমন, আমি তো চেষ্টা করছি। আল্লা মুখ তুলে চাইলে সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। শুধু একটু ধৈর্য ধর’। পাঁচ মাস ধৈর্য ধরেছে সুলতানা। এবার ধৈর্যের সীমা বাঁধ ভাঙছে। খুদা বক্স এখনও সারাদিন বাইরেই কাটায়। আর খাঁচায় বন্দী পাখির মতো সুলতানা গুমরে মরে। কয়েকদিন পরেই মুহরমের মাস। এই মাসে সুলতানা সব ধর্মীয় আচার নিষ্ঠাভরে মেনে চলে। কারাবালারমরু প্রান্তরেচোদ্দশো বছর আগেপয়গম্বরের পৌত্র হাসান আর তাঁর সঙ্গীরা মৃত্যু বরণ করেছিল! শোকের এই ঘটনাকে চোখের জলে স্মরণ করে সুলতানা। এই মাসে সে কালো কাপড় ছাড়া পরে না।
কিন্তু এ বছর তার কী হবে? নতুন কাপড় কেনার মতো হাতে পয়সা নেই। রাস্তার ওপারের কোঠাওয়ালি মুখতার কী সুন্দর একখানা লেডি হ্যামিলটন মার্কা দামি কাপড়ের কুর্তা বানিয়েছে! তার হাতাদুটো আবার জর্জেটের। কী মানিয়েছে ওকে! কুর্তার সঙ্গে মানানসই কালো সালওয়ার ও সে বানিয়েছে! কাপড়টা কী চকচকে! আর আনোয়ারি তো একটা জর্জেটের শাড়িও কিনে ফেলেছে। সুলতানাকে সে বলেছে এবার একটা সাদা সিল্কের পেটিকোটও কিনবে। এটা এই শাড়ির সঙ্গে খুলবে দারুণ। আনোয়ারি আবার কালো ভেলভেটের নরম তুলতুলে জুতোও কিনেছে। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে সুলতান। নিজেকে এতটা অসহায় তার কোনোদিনও মনে হয়নি। মুহরমে পরার মতো তার কাছে আজ কিচ্ছু নেই।
মুখতার আর আনোয়ারির সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরে সে একেবারে ভূমিশয্যা নিল। মেঝেতে শুধু মোটা কাপড়ের একখানা চাদর পাতা। বুকের ভেতরটা যদি দেখানো যেত তাহলে সে দেখিয়ে দিত কত দগদগে ঘা রয়েছে সেখানে। ঘর ফাঁকা। খুদা বক্স যথারীতি বাইরে। মোটা বালিশে মাথা গুঁজে অনেকক্ষণ চুপচাপ পড়ে রইল সে। তারপর ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ব্যালকনির দিকে ছুট লাগাল। আসলে সে গেলনা…কে যেন তাকে চালিয়ে নিয়ে গেল।
তার বুকের মতো রেল ইয়ার্ডও খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। কোনও ইঞ্জিন নেই। শুধু কয়েকটা বগি দাঁড়িয়ে আছে। রোজকার মতো আজও সন্ধেতে ভিস্তিওয়ালারা রাস্তায় জল ছিটিয়ে গেছে। তাই বাতাসে আর তত ধুলোর দাপট নেই। রাস্তায় জনাকয় লোক হেঁটে যাছে। এই সব কটা মিনসে একদম একই রকম। কোঠার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েগুলোকে হাঁ করে গিলবে, তারপর বাড়ি গিয়ে বউয়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকোবে। ওদের মধ্যেই একজন সুলতানার দিকে তাকাল। সুলতানা তাকে দেখে একটু হেসে আবার মুখ সরিয়ে নেয়। সব ফালতু আদমি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সুলতানা টের পায় লোকটা এখনও যায়নি। সে এখনও তার মুখের দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছে সুলতানা। সুলতানা লোকটাকে ইশারা করে ওপরে ডাকে। ওপরে আসার সিঁড়িটাও দেখিয়ে দেয়।
একটু পরেই লাজুক লাজুক মুখ করে লোকটা উঠে আসে। তাকে দেখেই সুলতানা জিগ্যেস করে… ‘তোমার কি এখানে আসতে ভয় করছিল’। লোকটাও সটান জবাব দেয়… ‘কেন এমন মনে হচ্ছে তোমার?’
‘না, দেখছিলাম তো এই জায়গাতেই অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছ। বোধহয় ভাবছিলে এগোবো কি এগোবো না!’
লোকটা আবার হেসে ফেলে… ‘আরে না না। আমি তো তোমার ওপরের ফ্ল্যাটের মেয়েটাকে দেখছিলাম। সে ছুঁড়ি কত ছলাকলা করে রাস্তার ওপারের ফ্ল্যাটের লোকটাকে পটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপরেই দেখলাম তোমার ঘরের সবুজ আলো জ্বলে উঠল…আর তুমি বারান্দায় বেরিয়ে এলে। সবুজ রং আমার খুব প্রিয়। চোখের খুব আরাম হয়’। এই বলেই লোকটা ঘরের ইতি উতি কী যেন খুঁজতে শুরু করে দেয়’।
গলা খাঁকরে সুলতানা জিগ্যেস করে… ‘কী ব্যাপার? উঠছ নাকি?’
‘না না। আমি একটু বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাই। তুমি আমাকে একটু ঘুরিয়ে দেখাবে?’
ঘরে তো মাত্র তিনটে ছোট ছোট কুঠুরি। তাই-ই সে ঘুরিয়ে দেখালো লোকটাকে। তারপর তারা মেঝের ওপর তাকিয়া পাতা বড় ঘরে ফিরে এল।
‘আমার নাম শংকর’…নিজে থেকেই কথা শুরু করে শংকর।
এই প্রথম লোকটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল সুলতানা। দোহারা চেহারা। দেখতেও অতি সাধারণ। কিন্তু চোখদুটো অসাধারণ…আলোয় ভরা। রগের কাছে চুলে অল্প পাক ধরেছে। একটা বেইজ রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে লোকটা। সে জামার কলারটা আবারতোলা। মাটিতে পাতা মোটা চাদরের ওপর আরাম করে বসে লোকটা। দেখে মনে হচ্ছে সে বাড়ির মালিক আর সুলতানা একজন পাতি খদ্দের। এভাবে বসে থাকতে না পেরে অনেকক্ষণ পরে মুখ খোলে সুলতানা… ‘বলো, আমি কী করতে পারি তোমার জন্য?’ মেঝের ওপর আরো জমিয়ে বসে লোকটা… ‘আমি আর কী বলি বলো? সবকিছু তোমার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি’। সুলতানা কোনও রা কাড়ে না। লোকটা উঠে পড়ে… ‘তুমি যখন এত করে জানতে চাইছ তখন বলেই দিই…আসলে তুমি আমাকে যা ভাবছ আমি তা নই। আমি কিন্তু পয়সা খরচ করতে তোমার কাছে আসিনি। আমি আমি না আসলে ডাক্তার। আমাকে সবাই ফি দেয়। আমাকে যারা ডাকে তারাই উলটে আমায় টাকা দেয়’।
সুলতানা তো হেসেই খুব… ‘তা কী কাজকম্ম করো তুমি?’
‘তুমি যা কর ঠিক তাই’।
‘ইয়ে আমি…মানে আমি কিছু করি না’।
‘তাহলে আমিও কিছু করিনা’।
‘ফালতু বকওয়াস মত করো। কিছু না কিছু তো কর’?
হিমশীতল গলায় শংকর জবাব দেয়… ‘তাহলে তুমিও তো কিছু না কিছু করো’
‘ আমি এটা সেটা করে সময় কাটিয়ে দিই’।
‘আমিও তাই’।
‘তাহলে চল আজ একসঙ্গেই এটা সেটা করা যাক’।
‘আমি রাজি। কিন্তু একটা শর্তে…আমি কিন্তু কোনও পয়সা দেবো না’।
‘মাথাটা কি একদম গেছে? এটা কোনও ধর্মশালা নয়’।
‘আর আমিও কোনও স্বেচ্ছাসেবী নই’।
‘স্বেচ্ছাসেবী কী জিনিস?’…অবাক হয়ে জিগ্যেস করে সুলতানা’।
‘স্বেচ্ছাসেবী…ঐ যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। একেবারে গর্দভ’।
‘আমি কিন্তু গর্দভ নই’।
‘তুমি না হলে কী হবে তোমার ঐ ঘরের মানুষ…ঐ যে খুদা বক্স সে একটা আস্ত একটা গর্দভ’।
‘কেন? সে কী করেছে?’
‘ কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখছি তো…ভাগ্য ফেরানোর আশায় এক ভণ্ড বাবাজির পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছে। আরে যার নিজের কপালই ফুটো…সে অন্যের কপাল কীকরে ফেরাবে!’
‘বাজে বোকোনা তো। তুমি তো হিন্দু তাই আমাদের ফকিরদের কেরামতির কথা তুমি জানো না। তোমরা তো মুসলিম ফকির দেখলেই হাসি-ঠাট্টা শুরু করে দাও’।
‘আরে এটা হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপারই নয়’।
‘তোমাদের সব চালাকি আমি বুঝি’… ‘আচ্ছা তুমি কি…
‘হতে পারে। কিন্তু আমার শর্তে’।
এবার সুলতানা উঠে দাঁড়ায়… ‘তাহলে আমিও আপনাকে দরজাটা দেখিয়ে দিই’।
শংকর উঠে দাঁড়ায়। পকেটে হাতটা পুরে বিজ্ঞের মতো বলে… ‘আমি এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করি। দরকার পড়লে আমায় ডেকো। আমি কিন্তু কাজের মানুষ’।
শংকর চলে যায়। কালো জামার কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যায় সুলতানা। কী অদ্ভুত না লোকটা! লোকটার কথা ভাবতে তার বেশ ভালোই লাগছে। সুলতানা ভাবে, এই মানুষটাই যদি তার আম্বালার কোঠায় আসত তাহলে সে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিত। কিন্তু এটা তো দিল্লি। এখানে সবই অন্য রকম। শংকর চলে যাওয়ার পরে তার খুব একা লাগছে। লোকটার কথাবার্তা, চালচলন…সবই যেন কেমন পারা!
সন্ধের সময় খুদা বক্স ঘরে ফেরে। তাকে রীতিমতো জেরা শুরু করে দেয় সুলতানা… ‘কোন চুলোয় ছিলে সারাদিন?’ খুদা বক্সকে দেখে মনে হয় সে একেবারে বিধ্বস্ত… ‘আরে আমি তো পুরানা কিলার ওখানে ছিলাম। ওখানেই কয়েকদিন আগে এক ফকির বাবার সঙ্গে দেখা। আমি তো নিত্যদিন তাঁরই সেবায় লেগে আছি…যদি আমাদের ভাগ্যটা ফেরে’।
‘তা বাবাজি কিছু বলেছেন?’
‘না এখনও কিছু বলেননি। আসলে তিনি এতদিন আমার দিকে নজরই দিতে পারেননি। তবে সুলতানা আমিও বলে দিলাম আমার এত ভক্তি…সেবা কিছুই বিফলে যাবে না। আল্লার কৃপায় কপাল আমাদের ফিরবেই’।
সুলতানার আবার মুহরমের কথা মনে পড়ে যায়। কান্নাবোজা গলায় সে বলে… ‘তুমি তো সারাদিন বাইরে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আমার যে কীভাবে এই বদ্ধ খাঁচায় দিন কাটে! আমি কোথাও বেরোতে পারি না। কয়েকদিন পরেই মুহরম। আমার যে একটা কালো জামা দরকার সে কথা কি তোমার খেয়াল আছে? আমার হাতে একটা পয়সা নেই। শেষ বালাটাও বেচে দিয়েছি। এবার আমাদের কী হবে ভেবে দেখেছ? তুমি তো সারাদিন যত ভিখিরি আর ভন্ড বাবাজি আছে তাদের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আমাদের কিসমতই ফুটা। দিল্লিতে আল্লাও আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তুমি রাস্তায় রাস্তায় আবার ফটো তুলতে পার না? তাতে দুটো পয়সা তো অন্তত হাতে আসবে’।
খুদা বক্স মাটিতে শুয়ে পড়ে… ‘কিন্তু তার জন্যও তো আমার কিছু মূলধন লাগবে। আমাদের হয়তো আম্বালা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। কিন্তু কী করব বল! সব আল্লার মর্জি! কে জানে যা হচ্ছে তা হয়তো ভালোর জন্যই হচ্ছে! এই কঠিন সময়ে ফেলে আল্লা হয়তো আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন…’। মাঝ পথেই তাকে থামিয়ে দেয় সুলতানা… ‘তোমার কাছে হাতজোড় করছি যেখান থেকে হোক আমার জন্য সালওয়ারের কালো কাপড় এনে দাও। আমার কাছে সাটিনের সাদা কুর্তা আছে। সেটা নাহয় কালো রং করিয়ে নেওয়া যাবে। আম্বালায় থাকতে দিওয়ালির সময় তুমি একটা সাদা শিফনের দুপাট্টাও এনে দিয়েছিল। সেটাও রং করে নেব। কিন্তু কালো সালওয়ার পাই কোথা থেকে? আমি জানি না, তুমি চুরি কর, ডাকাতি কর কিন্তু যেভাবেই হোক আমায় কালো সালওয়ারটা এনে দাও। আমি মাথার দিব্যি দিচ্ছি তুমি যদি ওটা এনে না দাও তাহলে কিন্তু আমার মরা মুখ দেখবে’।
খুদা বক্স উঠে পড়ে… ‘তোর ঐ বকওয়াস বন্ধ কর তো। আমিই বা কোত্থেকে টাকা পাব? আমার হাতেও ফুটোকড়ি নেই’।
সুলতানা তার সাফ কথা জানিয়ে দেব… ‘আমি কিচ্ছু জানি না। আমার কালো সাটিনের সাড়ে চার গজ কাপড় লাগবে। এই আমার শেষ কথা’।
‘আল্লার কাছে দোয়া কর…আজ রাতে যেন তিন-চারজন খদ্দের পাঠিয়ে দেন’।
‘কেন তোমার মুরোদ নেই? তুমি নিজে কিছু করতে পারো না? তুমি যদি মন দিয়ে চেষ্টা করতে তাহলে ঐ চার গজ কাপড় কেনার জন্য পয়সা রোজগার করতেই পারতে। যুদ্ধের আগে এক গজ কাপড়ের দাম ছিল বারো থেকে চোদ্দ পয়সা। এখন আর কত হবে? এক টাকা…দেড় টাকা…এর বেশি তো আর নয়! সাড়ে চার গজ কাপড়ের জন্য কত আর টাকা লাগবে তাহলে?’
‘তুই যখন এত করে বলছিস তখন দেখি কী করতে পারি। এখন কিছু খাওয়া দরকার। তুই একটু বস। আমি নীচের দোকান থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসি’।
তার চুপচাপ বাজারের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। সকাল হতে না হতেই খুদাবক্স আবার হাওয়া। সুলতানা সেই একাই পড়ে থাকে। একবার শোয়, একবার ওঠে। সময় কাটাতে কিছুক্ষণ ঘরে পায়চারি করে। দুপুরে কোনও রকমে একটু কিছু মুখে তুলে তোরঙ্গ থেকে সেই সাদা দুপাট্টা আর সাটিনের কুর্তাটা বের করে। তারপর সেগুলোকে রং করাতে লন্ড্রিতে নিয়ে যায়। বাড়ি ফিরে এসে পুরোনো হলদেটে হয়ে আসা ফিল্মি পত্রিকায় একটু চোখ বোলায়। এই সব পত্রিকায় তার সব প্রিয় সিনেমার সংলাপ আর গানগুলো রয়েছে যে! পড়তে পড়তেই ঝিমুনি আসে। ঘুম ভেঙে উঠে দেখে চারটে বেজে গেছে। স্নানটান করে কাচা জামা কাপড় পরে গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে দাঁড়িয়েই ঘণ্টা খানেক কেটে যায়। সন্ধে নামছে। নীচে রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। বাতাসে কেমন যেন একটা শীত শীত ভাব। হঠাৎ করে শংকরকে চোখে পড়ে যায় তার।শংকরও তার দিকে চেয়ে হাসে। কিছু না ভেবেই শংকরকে সে ডেকে বসে।
শংকর আসতে তার একটু বাধো বাধো লাগে। কী বলবে সে বুঝে পায় না। কিন্তু শংকরের ওসব বালাই নেই। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে এমন ভাবে বসে পড়েছে যেন এটা তার নিজের বাড়ি। সুলতানা কোনও কথা বলার আগে শংকরই বলে বসে… ‘দেখো কোন লজ্জার ব্যাপার নেই। তুমি আমায় হাজারবার ডাকতে পারো। আবার হাজারবার তাড়িয়েও দিতে পারো। আমি কিছু মনে করব না’।
‘তোমাকে কেউ চলে যেতে বলছে না’।
‘তাহলে আমার শর্তে রাজি তো?’…শংকরের মুখে দুষ্টু হাসি।
সুলতানাও হেসে খুন… ‘কীসের শর্ত? তুমি কি আমায় শাদি করবে নাকি?’
‘শাদি? ছিঃ। ওসব কথা কেউ মুখে আনে? যতদিন বাঁচব ততদিন ঐ চক্করে তো পড়বই না। ঐ বিয়েশাদি আমাদের জন্য নয়’।
‘বাজে কথা বন্ধ করো ত…কামকাজের কথা বল’…ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুলতানা।
‘আমি কী বললে তুমি খুশি হবে? দেখো তুমি একজন মহিলা। তুমিই এমন একটা কিছু বল যাতে আমাদের দুজনেরই সময়টা ভালো কাটে। এইসব বাজে গুলতানি মারার চেয়ে জীবনে আরো অনেক কিছু করার আছে’।
‘তুমি কী চাও বলতো?’
‘সব পুরুষ মানুষ যা চায়’…শংকরের সাফ জবাব।
‘তাহলে সব পুরুষের সঙ্গে তোমার তফাতটা কীসে?’
‘ দেখো তোমার আর আমার মধ্যে কোনও তফাত নেই। কিন্তু অন্য পুরুষদের চেয়ে আমার আকাশ-পাতাল তফাত। দেখো সব কিছুতে কোনও প্রশ্ন হয় না। নিজেকে বুঝে নিতে হয়’।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলতানা… ‘বুঝেছি’।
‘ তাহলে কী করা যায়?’
‘ ঠিক আছে, তুমিই জিতে গেলে। এরকম কোনও ব্যাপার হয় বলে বাপের জম্মে শুনিনি’।
‘তুমি তো অনেককিছুই শোননি। তোমার আসেপাশে যে হাজার হাজার পরিবার থাকে তারা কি ভাবতে পারে যে কোনও মেয়ে তার শরীর ভাঙিয়ে খাবে? কিন্তু তোমার কাছে তো এটা জলভাত। শুধু তুমি কেন? এই শহরে আরো হাজার হাজার মেয়ের কাছে এটাই বেঁচে থাকার উপায়। তোমার নাম তো সুলতানা। তাই না?’
‘হ্যাঁ তাই’।
‘আমি শংকর…এই সব নামে কী এসে যায়? তার চেয়ে চলো আমরা পাশের ঘরে যাই’।
পাশের ঘর থেকে যখন তারা বেরিয়ে এল তখন দুজনের মুখেই আর হাসি ধরে না। শংকর যেই বেরোতে যাবে অমনি সুলতানা এসে তাকে ধরে… ‘আমার একটা উপকার করতে পারবে?’
‘কী আগে শুনি?’
একটু দোনামনা করে সুলতানা… ‘ না মানে…তুমি হয়তো ভাববে যে এক্ষুনি যা হল তার বিনিময়ে আমি দাবি করছি?’
‘আরে বলেই ফেলো’।
বুকে একটু বল আনে সুলতানা… ‘না মানে…সামনেই তো মুহরম। একটা নতুন কালো সালওয়ার বানানোর জন্য আমার কাছে পয়সা নেই। আমি কী বলি বল? আমার আছে দুপাট্টা আর কুর্তা আছে…সেগুলো রং করতে দিয়েছি। কিন্তু সালোয়ারটাই নেই’।
‘তুমি সালওয়ার কেনার জন্য আমার কাছে পয়সা চাও?’
‘আমি মোটেও তা বলিনি। আমি বলেছি তুমি কি আমার জন্য একটা কালো সালওয়ার যোগাড় করে এনে দিতে পারবে?’
শংকরের মুখে এক চিলতে হাসি খেলে যায়… ‘দেখো আমার হাতেও পয়সাকড়ি বিশেষ থাকে না। তবে আমি কথা দিচ্ছি মুহরমের প্রথম দিনেই তুমি তোমার কালো সালওয়ার পেয়ে যাবে। এবার একটু হাসোতো দেখি!’…কথায় কথায় সুলতানার কানের দুলের দিকে নজর যায় শংকরের… ‘আমাকে এই দুল জোড়া দিতে পারবে?’
সুলতানা তো থ… ‘ এটা দিয়ে তুমি কী করবে? পাতি রুপোর। পাঁচ টাকার বেশি দামও হবে না’।
‘তোমাকে আমি এর দাম জিগ্যেস করিনি। শুধু আমি ওটা চেয়েছি’।
‘তাহলে নাও’…কান থেকে দুলজোড়া খুলে দেয় সুলতানা। শংকর চলে যাওয়ার পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পারে সুলতানা। এখন হাত কামড়ানো ছাড়া উপায় কী? চিরদিনের মতো দুলজোড়া তার চলে গেল।
সুলতানা ভালোমতোই জানে যে শংকর আর এমুখো হবে না।
মুহরমের প্রথমদিনই সক্কাল সক্কাল দরজায় টোকা। দরজার খুলে সুলতানা তো অবাক। ওপাশে শংকর। তার হাতে একটা খবরের কাগজের মোড়ক… ‘এই নাও তোমার কালো সাটিনের সালওয়ার। একটু বড় হতে পারে। দেখে নিও। এখন চলি’।
শংকরকে বড্ড আলুথালু দেখাচ্ছে। যেন এইমাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা এখানে চলে এসেছে। তাদের আর কোনও কথা হল না সেদিন।
শংকর চলে যাওয়ার পরে সুলতানা প্যাকেটটা খুলে দেখে এ যে কালো সিল্কের সালওয়ার ঠিক যেমনটা সে মুখতারের কাছে দেখেছিল। কানের দুলের দুঃখ সে ভুলে গেল।
বিকেলের দিকে সে কুর্তা আর দুপাট্টা আনতে লন্ড্রিতে গেল। তারপর নতুন জামাকাপড় পড়ে ফিটফাট হয়ে সে সবে বসেছে তখন আবার দরজায় টোকা। মুখতার। সুলতানাকে ভালোকরে মেপে নেয় মুখতার… ‘তা সুলতানা খবর কী? কুর্তা আর দুপাট্টা দেখে তো মনে হচ্ছে রং করা। কিন্তু সালোয়ারটা তো একদম নতুন। তুমি এটা বানিয়েছ বুঝি?’
‘হ্যাঁ আজই। সকালেই দর্জি এসে দিয়ে গেল। বেমালুম মিথ্যে বলে দেয় সুলতানা। হঠাৎকরে মুখতারের কানের দিকে নজর যায় সুলতানার… ‘এই দুলজোড়া কবে কিনেছ?’
মুখতার হেসে বলে… ‘আজই সকালে’।
অনেকক্ষণ তাদের মুখে আর কোনও কথা যোগায় না!

Loading

Leave A Comment